এই অধ্যায়ের শেষে শিক্ষার্থীরা নিম্নোক্ত বিষয়গুলো শিখতে পারবে—
আমাদের চারপাশে আমরা নানা ধরনের শক্তি দেখি, আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এই শক্তি আমরা নানাভাবে ব্যবহার করি। তাপ ঠিক সেইরকম একটি শক্তি এবং আমাদের জীবনে আমরা সবাই এই শক্তির সঙ্গে পরিচিত এবং কোথাও না কোথাও ব্যবহার করেছি।
আমরা তাপ প্রয়োগ করে রান্না করি, চা-কফি খাওয়ার জন্য তাপ দিয়ে পানি গরম করি, কাপড় ধুয়ে তাড়াতাড়ি শুকাতে চাইলে রোদে কাপড় দিই। অনেক সময় ব্যক্তিগত স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য বাড়তি তাপ থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করি, রোদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ছায়ায় বসে বিশ্রাম নিই, গরমের সময় কালো কাপড় না পরার চেষ্টা করি। এই তালিকা যত ইচ্ছা লম্বা করা যাবে।
কিন্তু তোমরা কি জানো তাপশক্তিটা কীভাবে এসেছে? এক গ্লাস ঠান্ডা পানি আর এক গ্লাস গরম পানির মধ্যে পার্থক্য কী? ঠিক কী কারণে তাপশক্তি ঠান্ডা পানিতে নেই; কিন্তু গরম পানিতে আছে?
একসময় এই ব্যাপারটি নিয়ে মানুষের অনেক কৌতূহল ছিল, কিন্তু এখন আমরা জানি, সব পদার্থ অণু- পরমাণু দিয়ে তৈরি। এই অণু-পরমাণুগুলোর গতি বা কম্পনকে সামগ্রিকভাবে আমরা তাপ হিসেবে দেখি। অণু-পরমাণুগুলো যত বেশি ছোটাছুটি করবে, সেটি তত বেশি উত্তপ্ত বলে মনে হবে। এক গ্লাস ঠান্ডা পানির ভেতরকার পানির অণুগুলো স্থির হয়ে নেই, সেগুলোও ছোটাছুটি করছে। কিন্তু যখন তাপ দেওয়া হয় তখন সেই পানির ছোটাছুটি অনেক বেশি বেড়ে যায়। যদি বেশি তাপ দেওয়া হয়, তখন কোনো না কোনো পানির অণুর গতিবেগ এত বেড়ে যেতে পারে যে, সেটি পানি থেকে মুক্ত হয়ে বের হয়ে যেতে পারে। আমরা সেটাকে বাষ্পীভবন বলি।
তাপ বুঝতে হলে আমাদের প্রথমে তাপমাত্রা বলতে কী বোঝাই সেটিও বুঝতে হবে। তাপ হচ্ছে, শক্তির পরিমাণ এবং তাপমাত্রা হচ্ছে কোনোকিছু কতটুকু উত্তপ্ত কিংবা কতটুকু শীতল তার একটি পরিমাপ ।
আমরা বলে থাকি চা গরম এবং আইসক্রিম ঠান্ডা—গরম এবং ঠান্ডা কথাটি দিয়ে আমরা আসলে বোঝাই ‘তাপমাত্রা' নামক রাশিটি চায়ের মধ্যে বেশি এবং আইসক্রিমের মধ্যে কম। কাজেই যদি আমাদের সহ্য ক্ষমতার মধ্যে থাকে তাহলে আমরা তাপমাত্রাটি আমাদের শারীরিক অনুভূতি দিয়ে বুঝতে পারি। তাপমাত্রা বেশি হলেই তার তাপের পরিমাণ বেশি হবে, সেটি কিন্তু সত্যি নয় ।
ধরা যাক একটি পাত্রে কিছু পানি নিয়ে সেটাকে একটা মোমবাতির শিখায় এক মিনিট ধরে রেখেছ। তারপর পাত্রের পানিতে স্পর্শ করলে হয়তো আগের থেকে অল্প একটু বেশি উষ্ণ বলে মনে হতে পারে। কিন্তু তুমি যদি একটি সুচ মোমবাতির শিখায় এক মিনিট ধরে রাখো, সেটি গনগনে গরম হয়ে যাবে এবং তুমি সেটা স্পর্শ করতেই পারবে না। যার অর্থ একই পরিমাণ তাপ প্রদান করার পরও পানির ক্ষেত্রে তাপমাত্রা ছিল কম এবং সুচের ক্ষেত্রে তাপমাত্রা অনেক বেশি। আমরা যদি পদার্থের অণু-পরমাণুর ছোটাছুটি দিয়ে বিষয়টি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি, তাহলে বলব তাপ প্রদান করার পর পাত্রের পানির অণুর গতি বৃদ্ধি পেয়েছে কম কিন্তু সুচের পরমাণুগুলোর কম্পন বৃদ্ধি পেয়েছে অনেক বেশি।
কাজেই বলা যেতে পারে, তোমরা তাপ সম্পর্কে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি জেনে গেছে, সেটি হচ্ছে তাপ এক ধরনের শক্তি এবং এই শক্তিটা এসেছে পদার্থের অণু-পরমাণুর সম্মিলিত গতিশক্তি কিংবা কম্পন শক্তি থেকে। অণুগুলোর গতি কিংবা কম্পন যত বেশি হবে, বস্তুটির তাপমাত্রা তত বেশি। কঠিন পদার্থের বেলায় তাপের অর্থ অণুগুলোর কম্পন। তরল পদার্থের বেলায় সেটি হচ্ছে অণুগুলোর ছোটাছুটি এবং গ্যাসের বেলায় সেটি হচ্ছে একটি অন্যটির তুলনায় মুক্তভাবে ওড়াউড়ি। যতবেশি কাপাকাপি, ছোটাছুটি কিংবা ওড়াউড়ি, তাপমাত্রা ততবেশি।
তাপমাত্রার আন্তর্জাতিক একক হচ্ছে কেলভিন (K) যদিও আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আমরা সেটা কখনো ব্যবহার করি না। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আমরা তাপমাত্রার জন্য যে এককটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করি, সেটি হচ্ছে সেলসিয়াস (C) এবং মধ্যে মধ্যে জ্বর মাপার জন্য সেলসিয়াসের পাশাপাশি ফারেনহাইট (F) স্কেল ব্যবহার করি। ফারেনহাইট স্কেলে শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা 98.4°F সেলসিয়াসে যেটা 37°C। নিচে তিনটি স্কেলের তুলনা দেখানো হলো।
স্কেল | একক | পানি জমে বরফ হওয়ার তাপমাত্রা | পানি ফুটে বাষ্প হওয়ার তাপমাত্রা | পানি বাষ্পীভবনের তাপমাত্রা এবং বরফের গলনাংকের তাপমাত্রা পার্থক্য |
সেলসিয়াস | °C | ০ | ১০০ | ১০০ |
কেলভিন | K | ২৭৩.১৫ | ৩৭৩.১৫ | ১০০ |
ফারেনহাইট | °F | ৩২ | ২১২ | ১৮০ |
সেলসিয়াস এবং কেলভিনের স্কেল তুলনা করলে তোমরা দেখবে সেলসিয়াস স্কেলের তাপমাত্রার সঙ্গে 273.15° যোগ করা ছাড়া আর কেলভিন স্কেলে আর কোনো পার্থক্য নেই। স্বাভাবিকভাবেই তোমরা নিশ্চয়ই প্রশ্ন করবে সেলসিয়াসের এত সহজ-সরল স্কেলের সঙ্গে ২৭৩.১৫ সংখ্যা যোগ দিয়ে কেলভিন স্কেল তৈরি করার কারণ কী?
কারণটি কিন্তু অত্যন্ত চমকপ্রদ। তুমি যেকোনো কিছুর তাপমাত্রা যত ইচ্ছা বাড়াতে পারবে, তার কোনো সীমা নেই! কিন্তু তাপমাত্রা যত ইচ্ছা কমাতে পারবে না। তাপমাত্রার একটা সর্বনিম্ন মান আছে। সত্যি কথা বলতে কী তুমি এই তাপমাত্রার কাছাকাছি যেতে পারবে কিন্তু কখনই সেই তাপমাত্রায় পৌঁছাতে পারবে না। এটাকে বলে পরম শূন্য তাপমাত্রা। কেলভিন স্কেলটি তৈরি করা হয়েছে এই পরম শূন্য তাপমাত্রাকে শূন্য ডিগ্রি ধরে। সেলসিয়াস স্কেলে এই তাপমাত্রা হচ্ছে -273.15° তাই সেলসিয়াস স্কেলের সঙ্গে 273.15 যোগ দিলে কেলভিন স্কেল পাওয়া যায়। যাই হোক সেলসিয়াস স্কেলের পাশাপাশি ফারেনহাইট নামে আরও একটি তাপমাত্রা স্কেল কোনো কোনো দেশে এবং জ্বর মাপার থার্মোমিটারে ব্যবহার করা হয়। সেই স্কেলে বরফের তাপমাত্রা 32°F এবং ফুটন্ত পানির তাপমাত্রা 212°F।
তাপ এক ধরনের শক্তি এবং আমাদের নানা কাজে আমরা এই তাপ শক্তিকে ব্যবহার করি। কোনো কিছু সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হলে সেটাকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিতে হয়। কাজেই তাপশক্তিকে আমাদের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিতে হয় কিংবা সঞ্চালন করতে হয়। তিনটি উপায়ে তাপ সঞ্চালন করা হয় সেগুলো হচ্ছে তাপের পরিবহন, পরিচলন এবং বিকিরণ।
পরিবহন: আমরা সবাই রান্না করা বিষয়টির সঙ্গে পরিচিত। তোমরা সবাই দেখেছ রান্না করার জন্য চুলার আগুনের ওপর একটি ডেকচি রাখা হয় এবং আগুনের উত্তাপ ডেকচির মাধ্যমে পরিবহন হয়ে ডেকচির ভেতর যা কিছু আছে তাতে সঞ্চালিত হয়। আমরা সবাই দেখেছি, তাপ যেন ঠিকভাবে সঞ্চালিত হতে পারে, সেজন্য দেখছি ডেকচিগুলো তাপ পরিবাহী পদার্থ দিয়ে তৈরি হয়।
আমরা যেহেতু জেনে গেছি কঠিন পদার্থের বেলায় তাপ হচ্ছে অণুগুলোর কম্পন তাই এবারে আমরা খুব সহজেই তাপের পরিবহন বুঝতে পারব। যখন কঠিন পদার্থের এক প্রান্ত উত্তপ্ত করা হয়, তখন সেই প্রান্তের অন্যগুলো নিজের জায়গা থেকেই কাঁপতে থাকে। তোমরা কল্পনা করতে পারো একটি অণুর সঙ্গে অন্য অণু একটা স্প্রিং দিয়ে যুক্ত। তাই একটা অণু কাঁপতে থাকলে সেটি তার পাশের অন্য অণুকেও কাঁপাতে শুরু করে। সেই অণুটি তখন তার পাশের অণুকে কাঁপায়। এভাবে কম্পনটি কঠিন পদার্থের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পরিবাহিত হয়।
পরিচালন: তুমি যদি কেটলিতে পানি রেখে চুলায় সেটা গরম করো, তাহলে কিছুক্ষণের মধ্যে সেটা ফুটতে শুরু করে। কেটলির সমস্ত পানি উত্তপ্ত হওয়ার জন্য কিন্তু তাপের পরিবহন প্রক্রিয়া কাজ করে নি। তোমরা যারা গ্রীষ্মের দুপুরে পুকুরের পানিতে ঝাঁপ দিয়েছে তারা সবাই লক্ষ করেছ পুকুরে পৃষ্ঠদেশের পানি মোটামুটি উত্তপ্ত হলেও পুকুরের নিচের পানি কিন্তু যথেষ্ট শীতল। পুকুরের পানি যদি পরিবহন পদ্ধতিতে গরম হতো তাহলে পৃষ্ঠদেশ থেকে ধীরে ধীরে নিচের পানিও গরম হতে শুরু করত।
তরল পদার্থের বেলায় সেটি গরম হওয়ার সময় ভিন্ন একটি প্রক্রিয়া কাজ করে থাকে, সেটির নাম হচ্ছে পরিচলন। এই পদ্ধতিটি বোঝার আগে আমাদের আরও একটি বিষয় জানতে হবে, সেটি হচ্ছে তরল কিংবা গ্যাসকে উত্তপ্ত করা হলে তার ঘনত্ব কমে সেটি হালকা হয়ে যায়। আমরা এখন তার কারণটাও ব্যাখ্যা করতে পারব। কোনো তরল যদি উত্তপ্ত করা হয়, তাহলে তার অণুগুলোকে আরো বেশি বেগে ছোটাছুটি করতে হয় বলে তার বেশি জায়গার প্রয়োজন হয়—কাজেই একই পরিমাণ তরল একটু বেশি জায়গায় নিয়ে থাকলে তার ঘনত্ব কমে যায় বা সেটি হালকা হয়ে যায়। কাজেই কেটলিতে পানি গরম করার সময় কেটলির তলায় স্পর্শ করা পানি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে উপরে উঠে যায়, তখন পাশের শীতল পানিও সেখানে উপস্থিত হয়। এভাবে পানির ভেতর একটা অভ্যন্তরীণ পরিচলন শুরু হয়, সেটি সকল পানিকে খুব ভালোভাবে মিশিয়ে পানিকে উত্তপ্ত করে।
গ্যাস উত্তপ্ত হলে হালকা হয়ে যায়, আমরা সেটা আগুনের শিখার দিকে তাকালেই বুঝতে পারি। সব আগুনের শিখা সব সময় উপরের দিকে উঠে। আগুনের শিখা হচ্ছে উত্তপ্ত জ্বলন্ত গ্যাস, কাজেই সেটি হালকা হয়ে উপরে উঠে। তুমি কখনো আগুনের শিখাকে অন্য কোনোদিকে ছড়াতে দেখবে না, শুধু ভরশূন্য মহাকাশযানে আগুনের শিখা উপরের দিকে না উঠে চারপাশে সমানভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
বিকিরণ: আমরা যদি জ্বলন্ত আগুনের পাশে দাঁড়াই, তখন এক ধরনের তাপ অনুভব করি। এই তাপটি পরিবহনের মাধ্যমে তোমার কাছে আসেনি, পরিচালনার মাধ্যমেও আসিনি। আমরা যখন রোদে দাঁড়াই, তখন যে তাপ অনুভব করি, সেই তাপও পরিবহন কিংবা পরিচলন পদ্ধতিতে সূর্য থেকে তোমার কাছে পৌঁছায়নি, এই তাপ সঞ্চালনের পদ্ধতির নাম বিকিরণ।
তোমরা আগের শ্রেণিতে দৃশ্যমান আলোর সঙ্গে সঙ্গে অদৃশ্য আলোর কথা পড়েছিলে। এই অদৃশ্য আলোর অবলাল অংশটুকুর একটা অংশ আমরা চোখে না দেখলেও তাপ হিসেবে অনুভব করতে পারি। কাজেই যখন আমরা আগুনের পাশে দাঁড়াই তখন আমরা সেই অদৃশ্য তাপরশ্মিকে অনুভব করেই সেটাকে আমরা বিকিরণ বলে থাকি। বিকিরণের জন্য কোনো মাধ্যমের দরকার হয় না, সেজন্য সূর্য আর পৃথিবীর ভেতরে মহাশূন্য থাকার পরেও দৃশ্যমান আলোর সঙ্গে অদৃশ্য অবলাল রশ্মি এবং অতিবেগুনি রশ্মি পৃথিবীতে চলে আসতে পারে।
গরম চা বা কফি খাওয়ার সময় তোমার হাতে যদি এক ফোঁটা গরম চা বা কফি পড়ে, তুমি নিশ্চয়ই সঙ্গে সঙ্গে হাত সরিয়ে নেবে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, কেউ যদি তোমার হাতে একই তাপমাত্রার বাতাস প্রবাহ করে, তুমি একটুখানি গরম অনুভব করবে, কিন্তু মোটেও তোমার হাতে গরমের ছ্যাঁক লাগবে না। যারা উত্তপ্ত ওভেনে কেক তৈরি করে, তারা খুবই সতর্ক থাকে যেন ওভেনের ধাতব অংশ তাদের হাতের কোনো জায়গায় স্পর্শ না করে। কিন্তু ওভেনের উত্তপ্ত বাতাস নিয়ে মাথা ঘামায় না, যদিও দুটোই একই তাপমাত্রায় থাকে।
এখন প্রশ্ন হলো, কেন উত্তপ্ত তাপমাত্রার পানি বা ধাতুর সংস্পর্শে এলে আমরা যন্ত্রণা অনুভব করি কিন্তু একই তাপমাত্রার বাতাসের সংস্পর্শে এলে আমরা কেন সেই প্রচণ্ড উত্তাপ অনুভব করি না?
তার কারণ একটি উত্তপ্ত জায়গায় সংস্পর্শে এলে আমাদের শরীরের ত্বক সেই তাপ অনুভব করবে, কিন্তু কি পরিমাণ তাপ আমাদের শরীরে প্রবাহিত হবে, সেটি নির্ভর করে সেই বস্তুগুলো কী পরিমাণ তাপ ধারণ করে আছে। যদি সেটির তাপ ধারণ ক্ষমতা বেশি হয়, তাহলে সেটি তোমার শরীরে অনেক তাপ সরবরাহ করে তোমার হাতে যন্ত্রণা তৈরি করতে পারে। কিন্তু যদি সেই বস্তুর তাপ ধারণ ক্ষমতা কম হয়, তাহলে সেটি তোমার শরীরে অল্প তাপ পরিবহন করবে এবং তুমি সম্ভবত একটু গরম অনুভব করা ছাড়া কিছুই টের পাবে না।
একটা বস্তুতে কী পরিমাণ তাপ সঞ্চিত আছে সেটি নির্ভর করে বস্তুটি তাপমাত্রা, তার ভর এবং তার আপেক্ষিক তাপের উপর। যেহেতু বাতাসের ভর খুবই কম তাই তার তাপ ধারণ করার ক্ষমতা খুবই কম। একটি পদার্থের আপেক্ষিক তাপ কম হলে অল্প তাপ প্রদান করেও অনেক উচ্চ তাপমাত্রার নেওয়া যায়। অন্যদিকে একটি পদার্থের আপেক্ষিক তাপ বেশি হলে একই তাপমাত্রা নেওয়ার জন্য অনেক তাপ প্রদান করতে হয়।
দুটি বস্তুর তাপমাত্রা যদি ভিন্ন হয় এবং দুটিকে যদি একটি সংস্পর্শে অন্যটিকে আনা হয়, তাহলে যে বস্তুর তাপমাত্রা বেশি, সেখান থেকে তাপ যে বস্তুর তাপমাত্রা কম সেখানে প্রবাহিত হবে। সে কারণে তাপের প্রবাহের দিক দিয়ে অনেক সময় তাপমাত্রার সংজ্ঞা দেওয়া হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত দুটি তাপমাত্রা একই জায়গায় না পৌঁছাবে ততক্ষণ তাপের প্রবাহ হতেই থাকবে।
একটি সুচকে আগুনে উত্তপ্ত করা হলে তার ভেতরে মোট তাপের পরিমাণ খুব বেশি হবে না। সেই তুলনায় একটা বালতি ভরা পানিতে তাপের পরিমাণ অনেক বেশি। কিন্তু গরম সুচটিকে যদি পানিতে ছেড়ে দেওয়া হয়, তাহলে সুচটির তাপের পরিমাণ কম হলেও সেটি বালতির পানিতে তার তাপ প্রবাহিত করবে।
তোমরা ইতিমধ্যে জেনে গেছ সব পদার্থ অণু দিয়ে তৈরি এবং কঠিন পদার্থে অণুগুলো নির্দিষ্ট অবস্থানে থেকে একে অন্যকে আটকে রাখে। তাপ দেওয়া হলে এগুলোর কম্পন বেড়ে যায় এবং আণবিক বন্ধন শিথিল হয়ে একে অন্যের ওপর গড়াগড়ি খেয়ে নড়তে শুরু করে এবং এটাকে আমরা বলি তরল। তাপমাত্রা যদি আরও বেড়ে যায়, তখন অণুগুলো মুক্ত হয়ে ছোটাছুটি শুরু করে, তাকে আমরা বলি গ্যাস। তবে বিশেষ বিশেষ কঠিন পদার্থকে তাপ দিলে সেটি সরাসরি গ্যাসে রূপান্তরিত হতে পারে। এই পরিবর্তনগুলো ভৌত পরিবর্তন, কাজেই তাপ সরিয়ে নিয়ে এই তিনটি অবস্থার বিপরীত পরিবর্তনগুলোও ঘটানো সম্ভব। পাশের ছবিতে তাপ প্রয়োগ করে পদার্থের এই তিন অবস্থার পরিবর্তনগুলো দেখানো হয়েছে।
কঠিন থেকে তরল এবং তরল থেকে কঠিন: একটা কঠিন পদার্থকে যখন তাপ দেওয়া হয়, তখন তার তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। তাপমাত্রা একটা নির্দিষ্ট মানে পৌঁছালে কঠিন পদার্থটি গলতে শুরু করে। এই প্রক্রিয়াটির নাম গলন, আমরা এক টুকরা বরফকে বাইরে রেখে দিলে সেটি চারপাশের বাতাস থেকে তাপ গ্রহণ করে গলতে থাকে । যে তাপমাত্রায় গলন শুরু হয়, সেটাকে বলে গলনাঙ্ক । বরফের গলনাংক ০ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
তাপ দিয়ে কঠিন থেকে তরল যে রকম রূপান্তর করা হয় তার উল্টো প্রক্রিয়াটিও ঘটে। তাপ সরিয়ে নিলে একটা তরল কঠিন হতে পারে। তরল অবস্থা থেকে কঠিন অবস্থায় রূপান্তরিত হওয়াকে কঠিনীভবন (Solidification) বলে। জ্বলন্ত মোমবাতি থেকে যে গলিত মোম গড়িয়ে পড়ে, সেটি শীতল হয়ে আবার কঠিন হয়ে যায়, এটি কঠিনীভবনের একটি উদাহরণ।
তরল থেকে গ্যাস এবং গ্যাস থেকে তরল: তরল পদার্থকে তাপ দিলে তার তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করে এবং তাপমাত্রা বাড়তে বাড়তে এক সময় তরল পদার্থটি গ্যাসে পরিবর্তিত হতে শুরু করে। এই প্রক্রিয়াটির নাম বাষ্পীভবন এবং যে তাপমাত্রায় বাষ্পীভবন ঘটে, সেটাকে বলে স্ফুটনাঙ্ক। পানির স্ফুটনাংক ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
তাপ দিয়ে তরল থেকে গ্যাসে যে রকম রূপান্তর করা হয় তার উল্টো প্রক্রিয়াটিও ঘটে। তাপ সরিয়ে নিলে একটা গ্যাস তরল হতে পারে। একটা গ্লাসে কয়েক টুকরা বরফ রেখে দিলে আমরা দেখতে পাই গ্লাসের গায়ে জলীয় বাষ্প শীতল হয়ে বিন্দু বিন্দু পানি হিসেবে জমা হয়েছে। বায়বীয় অবস্থা থেকে এভাবে তরল অবস্থায় রূপান্তরিত হওয়াকে ঘনীভবন (Liquification) বলে।
কঠিন থেকে গ্যাস এবং গ্যাস থেকে কঠিন: যে প্রক্রিয়ায় কোনো কঠিন পদার্থকে তাপ প্রদান করা হলে, সেগুলো তরলে পরিণত না হয়ে সরাসরি বাষ্পে পরিণত হয়, সেই প্রক্রিয়াকে ঊর্ধ্বপাতন (Sublimation) বলে । আমরা কাপড়ে পোকা না ধরার জন্য সেখানে ন্যাপথালিন ব্যবহার করতে দেখেছি। কঠিন ন্যাপথলিনকে তাপ দিলে সেটি তরল না হয়ে সরাসরি গ্যাসীয় পদার্থে পরিণত হয়।
ঊর্ধ্বপাতনের বিপরীত প্রক্রিয়াটির নাম Deposition যেখানে একটি পদার্থের বাষ্পকে শীতল করা হলে সেটি তরল না হয়ে সরাসরি কঠিন পদার্থে রূপান্তরিত হয়। আয়োডিন মেশানো খাদ্য লবণের মধ্যে আয়োডিন একটি ঊর্ধ্বপাতিত পদার্থ। কাজেই এই আয়োডিন মেশানো খাদ্য লবণের মিশ্রণকে তাপ দিলে আয়োডিন সহজেই বাষ্পীভূত হয়ে যায়, তখন ঐ বাষ্পকে ঠান্ডা করে আয়োডিনের বাষ্পকে সরাসরি কঠিন আয়োডিনে পরিণত করা যায়।
তোমরা ইতিমধ্যে জেনে গেছ সব পদার্থ অণু পরমাণু দিয়ে তৈরি এবং কঠিন পদার্থে অণুগুলো নির্দিষ্ট অবস্থানে থেকে একে অন্যকে আণবিক বল দিয়ে আটকে রাখে। এই বলকে আমরা ছবিতে দেখানো স্প্রিংয়ের সঙ্গে তুলনা করতে পারি। তাপ দেওয়া হলে এগুলোর কম্পন বেড়ে যায়, তাই কম্পনের জন্য এগুলো একটু বেশি জায়গা নেয় এবং মনে হয় পদার্থের আয়তন বেড়ে গেছে। তাপ দিয়ে অনেক ধরনের কঠিন পদার্থ বিশেষত ধাতব বস্তুকে নরম করা যায় এবং গলানো যায়, ফলে সেগুলোর দ্বারা বিভিন্ন আকৃতির বস্তু তৈরি করা সম্ভব হয় ৷
তরল এবং গ্যাসের বেলায় কণাগুলো আরও দ্রুত ছোটাছুটি শুরু করে, তাই সেগুলোর বেশি জায়গা প্রয়োজন হয় বলে মনে হয় সেগুলোর আয়তন প্রসারিত হয়েছে। থার্মোমিটার তৈরি করার সময় পারদের প্রসারণের এই ধর্ম ব্যবহার করা হয়।
তাপ প্রদান অথবা অপসারণের মাধ্যমে কঠিন, তরল ও গ্যাসীয় পদার্থের প্রসারন বা সংকোচনের পরিমাণ আলাদা আলাদা হয়ে থাকে।
১। এমন কোন তাপমাত্রা নেই যেটিতে সেলসিয়াস এবং কেলভিন স্কেলের মান সমান হতে পারে। (কেন?) কিন্তু একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় ফারেনহাইট এবং সেলসিয়াস স্কেলের মান সমান। সেটি কত হতে পারে?
Read more